লুকিয়ে রাখা ইতিহাস ও আদিবাসীরা (১)
পৃথিবীতে বড়ো বড়ো লুন্ঠনবাজ কম আসেনি । তারা শুধু ডাকাতিই করেন নি, তারা আপনার জায়গা জমি সব দখল নিয়েছেন । আবার যুক্তি সাজিয়েছেন, যেহেতু তোমার বাড়িতে রয়ে গেলাম, তাই আমায় তুমি ডাকাত বলতে পারবে না । চাপিয়ে দিয়েছে তার ভাষা- ধর্ম। তোমার ধর্ম ভালো না, তাই ওটার পরিবর্তন দরকার । তাই আক্রমণ শুধু আর্থিক নয়, সাস্কৃতিকও।
এদের কিন্তু লুন্ঠনবাজ বলতে পারবেন না, কারণ কেউ রাজার মুখোশধারী বা কেউ ব্যবসায়ীর। আজও না ।
পুরো বিষয়টি ক্রিস্টোফার কলম্বাস দিয়ে শুরু হয়েছিল। তিনি আদিবাসীদের নাম রাখেন ইন্ডিস। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে লোকেরা এসে স্থানীয় আমেরিকান মানুষকে বিভিন্ন নামে ডেকেছিল। যেমন ইন্ডিয়ান, ইন্ডিয়ানা । “পিউ রেগাস” বা রেড স্কিন নামটি পরে এসেছিল।সান সালভাদোরের বাসিন্দারা তাদের রীতিনীতি অনুসারে কলম্বাসকে বিনোদন দিয়েছিল। বাসিন্দারা দর্শনার্থীদের হাতে অনেক উপহার তুলে দেন ।
স্পেনের রাজাকে কলম্বাস লিখলেন যে এরা কম জামা কাপড় পরে কিন্তু এখানকার মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। এদের মধ্যে ধনী দরিদ্র নেই। এরা পাশের বাড়ির লোককে নিজের আত্মীয় মনে করে। আর এরা নিজেদের বাড়ি ঘর সব সময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে এবং নিজেরাও হাসি মুখেই থাকে।
কিন্তু তাদের এই গুনাবলীকে ইউরোপীয় লোকেরা এদের দুর্বলতা বলে মনে করেছিলেন। তাই সেই সময় 1492 থেকে 1890 , এই চারশো বছরে ইউরোপীয়রা, এসে এদের ধর্ম, সস্কৃতি, ভাষা ও জীবনপ্রণালী, সব কেড়ে নিয়েছেন।
এই কলম্বাস যাকে তারা, আদর আপ্যায়ন করলো, তিনি যাওয়ার সময় দশজন ওখানকার অধিবাসীদের বন্দী করে নিয়ে গেলেন। হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে, উপস্থিত করা হলো রাজার সামনে। তাদের মধ্যে নয়জনকে ধর্মান্তরিত করা হলো। একজন মারা গেছিলেন। আসলে ধর্মান্তরিত করা ছিলো, লুন্ঠন এর দিকে প্রধান পদক্ষেপ।
ইউনিয়নের ভাষ্য অনুযায়ী, তাইনো ও অন্যান্য আরায়ক জনগোষ্ঠী ইউনিয়ন ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বেশি বাধা দেয়নি। সমস্যা শুরু হলো, যখন ইউরোপীয়রা ওই অঞ্চলে সোনা এবং অন্যান্য ধাতুর খোঁজে ওই সব দ্বীপে অভিযান চালালো। তারা বাধা দিলে, স্পেনীয়রা গ্রামের পর গ্রাম আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিলো। দাস ও দাসী হিসেবে বিক্রি জন্য হাজার হাজার পুরুষ, নারী, বাচ্চাদের জাহাজে খোলে পুরে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আরায়কদের প্রতিরোধ গুড়িয়ে দেওয়া হলো কামান, বন্দুক আর তরোয়াল দিয়ে। কলম্বাস পা রাখার দশ বছরের মধ্যে ওই দ্বীপে আর কোন আদিবাসী রইলো না।
আসলে সেই সময় বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও খবর আদানপ্রদান ব্যবস্থাটি নিশ্চয়ই খুব দূর্বল ছিল, তাই ইউরোপীয়দের এই বর্বরতার খবর চারদিকে পৌছানোর আগেই শুরু হয় গেলো আবার এক একটি জায়গা দখল। সেখানের আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করে, বসতি স্থাপনের কাজ।
1607 এ ইংরেজরা প্রথম পা দেয়, ভার্জিনিয়ায়। ততদিনে আদিবাসীরা খানিকটা হলেও জেনে গেছে ইউরোপীদের মতলব। তাই চালাক ব্রিটিশ ও পথে হাঁটলো না। সেখানকার আদিবাসী নেতা বা গোষ্ঠীপতিকে পরিয়ে দিলো সোনার রাজমুকুট। তাকে ঘোষণা করা হলো রাজা পাওহাতান বলে। এতেও রাজার ওখানে বসতি স্থাপনের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ সাধারন আদিবাসীদের মধ্যে তীব্র ঘেন্না। এতে কাজ না হওয়ায়, প্রয়োগ করা এদের অতি পুরাতন বিদ্যে। তা হলো রক্তের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন। ইংরেজ সেনাপ্রধান জন রোলফে বিয়ে করলেন, রাজার মেয়েকে। এই ফর্মুলাতে কাজ হলো দারুণ। রাতারাতি ইংরেজ জামাই পেয়ে, রাজা যেন ইংরেজ রাজা হয়ে উঠলেন। তাই ওখানে ইংরেজদের বসতি স্থাপনের আর কোন অসুবিধা হলো না। রাজার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ই ইংরেজরা আক্রমণ নামিয়ে আনলো। একের পর এক আদিবাসীকে হত্যা করা হলো। সেই রাজকুমারীর কি হলো, তা অজানা। একশোর ও কম বেঁচে থাকা আদিবাসীকে ক্রীতদাস বানানো হলো।
ম্যাসাচুসেটস এ ইংরেজ এলো 1620 তে। তারা যখন জাহাজ থেকে নামলেন, তখন তারা অর্ধমৃত। কারণ জাহাজে রসদ শূন্য ছিলো, দশদিন। কিন্তু তাদের খারাপ অবস্থা দেখে খাদ্য ও পানীয় নিয়ে একান্ত বন্ধুর মতো এগিয়ে এসেছিল স্হানীয় আদিবাসীরা। যে আদিবাসীরা তাদের প্রান বাঁচাতে ছুটে এসেছিলেন, তাদেরই একদিনে হত্যা করেছিল
ইংরেজরা।
বসতি স্থাপনের জন্য অসহায় ইংরেজদের সেদিন সবরকম ভাবে সাহায্য করেছিল, আদিবাসীরা। তারা তাদের ঘর বানিয়ে দিলো, চাষের জন্য জমি দিলো। মাছ ধরতে শেখালো । অভাবে পড়লে শষ্য সরবরাহ করতো। এভাবেই পেরিয়ে গেলো, প্রথম শীতকালটা।
এই ভাবে শান্তিপূর্নভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকটি বছর। ইংরেজ এবং আদিবাসীরা রইলো পাশাপাশি একান্ত বন্ধুর মতো। কিন্তু ইংরেজদের জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটতে থাকলো দ্রুত। জাহাজ ভর্তি হয়ে তারা দলে দলে নামতে থাকলো উপকূলে। এলাকায় এলাকায় ধর্মান্তরিত করার এজেন্টদের আনাগোনা বেড়ে উঠলো। কিন্তু তারা আদিবাসীদের কয়েকজনকে বোঝাতে গিয়ে, ব্যার্থ হন। চারদিকে জঙ্গল কেটে গড়ে উঠেছিল ইংরেজদের বসতি । ওদিকে তখন কুঠারের আওয়াজে ভরে উঠেছে, আকাশ বাতাস। ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো বসতিগুলো। 1625 সালে বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই আদিবাসীদের জমি নেওয়ার চেষ্টা শুরু হলো। ইংরেজদের দাবি তাদের আরো বারো হাজার একর জমি তাদের দান করা হোক। আদিবাসীরা জানালেন জমি এসেছে পরমাত্মার কাছ থেকে এবং তাই এর মালিক কোন মানুষ নন। তাও তারা ইংরেজদের একটি কাগজে দাগ টেনে বেশ কিছুটা জমি দান করলেন।
কিন্তু এতেও ইংরেজদের লোভের মাত্রা বেড়েই চলেছিল। আর এর পাশাপাশি ধর্মান্তরিত করার বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে লাভ না হওয়ায়, শেষে 1675 সালে আদিবাসীদের হত্যাযজ্ঞে নামেন ইংরেজরা। চারদিকে ইংরেজদের বসতি দ্বারা ঘেরা হওয়ায় আদিবাসীরা পালাতে ও পারেননি। আর ইংরেজদের উন্নত অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেননি আদিবাসীরা। যে রাজা ইংরেজদের প্রানে বাঁচিয়ে ছিলো, খাদ্য দিয়েছিলো, জায়গা জমি দিয়েছিল, তার ছেলের গলাকেটে বাশেঁর উপর ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাকে এশিয়ার কোন দাসের হাটে বিক্রি করে দেওয়া হয়।