অপরিশোধিত খবর পাওরার অধিকার ‘ ১

এপার বাংলায় কার্টুন-কাণ্ডে ২০১২ সালের এপ্রিলে গ্রেফতার হয়েছিলেন অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। তারপর সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি। মুখ্যমন্ত্রীর বেলপাহাড়ির সভায় ‘প্রশ্ন করা শিলাদিত্য চৌধুরী। আমজনতার গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বের দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়।

আরামবাগ টিভি হলো হুগলি জেলার মহকুমা শহর আরামবাগের একটি ইউটিউব চ্যানেল। তার কার্যনির্বাহী সম্পাদক সফিকুল ইসলামকে সম্প্রতি ভোরবেলায় পুলিশ গিয়ে বাড়ির দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার করে। তাঁর স্ত্রী ও দুই চার ও নয় বছরের ছেলে-মেয়েকেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আরামবাগ টিভি-র সাংবাদিক সূরয আলি খানকেও। তাঁদের সাতদিন জেলে আটক থাকতে হয়।

বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হলেন তানভীর হাসান তনু। পেশায় সাংবাদিক। টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর কয়েকটা সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টালের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি। এক ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার হয়ে এই যুবক হাজতি হিসাবেী হাসপাতালে আটক আছে। মামলা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা।

কারণ, সে একটা রিপোর্ট করেছে এই কথা বলে যে হাসপাতালে রোগী প্রতি খাবারের জন্যে তিনশ টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয় সত্তর টাকার খাবার। এই রিপোর্টের কারণে তনুসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল তনুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তনু অসুস্থ ছিল, কয়েকদিন আগে তিনি করোনা থেকে ভাল হয়েছেন মাত্র। তাই পুরস্কার হাসপাতালে বন্দী রাখা হয়েছে।

সাংবাদিকদের উপর এই আক্রমণ উপমহাদেশে নতুন নয়। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার প্রথম আলো পত্রিকার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা এক মামলায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কারাগারে আটক রেখেছিলেন । ভারতের উত্তরপ্রদেশ পুলিশ মালায়ালাম-ভাষা সংবাদ পোর্টাল আজিমুখামের সাংবাদিক সিধিক কপ্পানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

বিশিষ্ট পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরকে অন্য এক সাংবাদিকের উপর হামলার প্রতিবাদে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার ঠিক কয়েকদিন পর থেকে একের পর এক আক্রমণ করা হচ্ছে । সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি

স্বাধীনতার দুটি ধারণা – পজিটিভ লিবার্টি বলতে চাওয়ার ভিত্তিতে পাওয়ার ক্ষমতা থাকা। যেখানে নেতিবাচক স্বাধীনতা মানে “কোনও মাস্টার না থাকা”। ইতিবাচক স্বাধীনতা বলতে শর্ত তৈরি করে বোঝায় যে ব্যক্তি তাদের নিজের মাস্টার হওয়ার সুযোগ দেয়। আর নেতিবাচক যেখানে আপনার উপরে কোন বল প্রয়োগ হচ্ছে না। ইংরেজি ভাষায় ” way of conceptualizing liberty, is in negative terms; being free from coercion, reaching your full potential without the interference by external others.” । স্বাধীন হওয়ার অর্থ স্বাধীন সত্তা যার নিজের ভবিষ্যতের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে ।
[ With reference to Mill’s (1859) position, Berlin (1969 [1958]: 126-7 –
emphasis in original) writes that ‘[t]he defense of liberty consists in the
negative goal of warding off interference ]

এটি নেতিবাচক কারণ, এই স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন কিছুর উপস্থিতি বিদ্যমান না থাকাটাই শর্ত। এই অনুপস্থিতটি হলো সরকারি হস্তক্ষেপ বা জবরদস্তির ।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে নেতিবাচক স্বাধীনতায়, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে সর্বনিম্নে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত।
কিন্তু এই ধারণার বাইরে বরং ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে আইন দ্বারা সুরক্ষিত করা দরকার।
আসলে রাষ্ট্র এটি প্রতিপন্ন করতে চায় যে
সমস্ত জবরদস্তি necessary evil এবং সমস্ত ছাড় বা হস্তক্ষেপ না করাটা inherently good । এটি আসলেই যা সর্বদা সত্য হয় না।

দ্বিতীয়টি, এই ইতিবাচক স্বাধীনতার ধারণাটি শুরু থেকেই ভিন্ন ভিত্তির উপর স্থাপিত । এখানে রাষ্ট্র স্বাধীনতার শর্তগুলির প্রতি সংবেদনশীল হয়। ব্যক্তিবাদী স্বাধীনতা এবং চাহিদার চেয়ে সমষ্টিগত আঙ্গিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উন্নয়নের মাধ্যম হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে বৃহত্তর কিছু হিসাবে সমষ্টিকে
কল্পনা করা যেতে পারে।
Positive freedom implicates the
common good and the development of a collective will through which the
individual is supposedly able to achieve ‘true’ or ‘genuine’ self-determination. As Berlin (1969 [1958]: 132 – emphasis in original) explains:

সামাজিক সামগ্রিক হিসাবে এই স্বতন্ত্র স্বাধীনতা র অন্য একটি দিক ও আছে : এই স্বাধীনতা সমগ্র জাতী – দেশ -সামাজিক এর বাইরে এসে গোটা বিশ্বের ভাবনা চিন্তায় প্রভাব ফেলতে পারে ।
ইতিবাচক স্বাধীনতা এইভাবে নিষিদ্ধ
না করে স্বাধীনতার শর্তগুলো কে শক্তিশালী করার নামে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজ নির্মাণের নামে ধ্বংস করে। আর এটা মগজ ধোলাই করে প্রথমেই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলে ।
নিখরচায় শিক্ষা, কিন্তু কি শিখবে তা সরকার ঠিক করবে । একই উপমহাদেশের তিনটি দেশ তিন রকম ধ্যান ধারণা, ইতিহাস পড়ায়। এই সব যুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠান্ডা ঘরে বসে, সরকার থেকে কোটি টাকা বেতনপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা যুক্তির পাহাড় সাজায়। আপনি – আমি সেই পাহাড়ে চড়ে নিজেদের মহান – আধুনিক বা শিক্ষিত বলি । এখানে থেকেই ধার করি যুক্তিবোধ তৈরী করি, সেটি দিয়েই আপনাকে শাসন করেন আপনি । কিন্তুধরা পড়ে যখন তা বাস্তবে র সাথে মেলে না।
আইন যখন বইতে লেখা থাকে। আইনের প্রয়োগ রাজনৈতিক দল বদলে ব্যস্ত থাকে।

আর এই বাস্তবএর চেহারা যারা, সমাজের সামনে আনেন, তারা হলেন সাংবাদিক। তাই এদের ওপরে আক্রমণ সবচেয়ে বেশি।

In 1977, Amadu Mohtar M’Bow, সেই সময় UNESCO’sএর Director-general ,
একটি International Commission for the Study of Communication কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিল । বিষয় ছিল নতুন communication technologies বা প্রযুক্তিগুলির উদীয়মান সমস্যা । এই ম্যাকব্রাইড রিপোর্ট, এর সাথে অনেক সম্মানিত মানুষ যুক্ত ছিলেন। যার নামে নামকরণ করা হয়েছে কমিশন, তিনি ছিলেন সান ম্যাকব্রাইড, একজন আইরিশ সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনীতিবিদ।

যা সামনে আসে তা হলো
– তথ্যের মতাদর্শগত জাত
এবং
– তথ্য বিধানের সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব ।

শীত যুদ্ধ আসলেই এই তথ্য যুদ্ধ ।যা ওই প্রতিবেদন ঈঙ্গিত দেয়, তা হলোআসলে এবং একমাত্র পুজিঁর স্বার্থে বা কোথাও দলের স্বার্থে রাষ্ট্র গড়ে তোলে তথ্যের অবকাঠামো । আর সেই রাষ্ট্র মেড তথ্য নিয়ে বিতর্ক বিতর্ক খেলায় মাতামাতি। একটিই কেন্দ্রবিন্দু মানুষকে অবহিত না হতে দেওয়া ।

এই প্রতিবেদনে, সাংবাদপত্রের বিপণনের মারাত্মক প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেন এবং তারা ” খবর ” বা Communication র সামাজিক প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিল। কারণ তারা মেনে নেন Communication রাষ্ট্র বা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিশোধিত করে পরিবেশন করা, মানুষের মানবাধিকার হরণ করার সামিল । অপরিশোধিত খবর পাওয়া মানুষের মানবাধিকার।
1969 সালে Jean d’Arcy তাঁর একটি প্রবন্ধে প্রথম “খবর পাওরার অধিকার বা ” The idea of a right to communicate ” এর কথা বলেন।
ম্যাকব্রাইড রিপোর্ট এ অপরিশোধিত খবর
পাওয়া কে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চেয়ে এগিয়ে রাখে।

পাকিস্তানের প্রবীণ টিভি সাংবাদিক হামিদ মীর শুক্রবার ইসলামাবাদে সাংবাদিক আসাদ তুরের উপর তিন ” অজ্ঞাতপরিচয় ” ব্যক্তির দ্বারা হামলার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশে জ্বলন্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর উপরে নেমে আসা একের পর এক আক্রমণের কথা তাঁর ভাষাতেই তুলে ধরা হলো।
” আজকের মতো
আমাকে টেলিসংবাদ থেকে সরিয়ে দেয়াটা একটি শ্রেণীর কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তারা আমাকে কারাগারে বন্দী দেখতে চেয়েছিল। মে মাসের শেষের দিকে আমাকে টকশোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি দুই দশক ধরে জিও নিউজের ‘ক্যাপিটাল টক’ উপস্থাপনা করে আসছি। পাকিস্তানের জনপ্রিয় উর্দু পত্রিকা দৈনিক জংয়ে আমার কলাম লেখাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা অভিযোগের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। এই আইনে আমার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপাতদৃষ্টিতে আমার অপরাধ একটি বক্তৃতা, যা আমি গত মে মাসে সাংবাদিক আসাদ তুরের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য এক বিক্ষোভ সমাবেশে করেছিলাম। ২৫ মে রাতে অজ্ঞাত তিন ব্যক্তি তুরের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। তাকে বেঁধে তার ওপর নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের ওপর ধারাবাহিক হামলার এটা ছিল সর্বশেষ ঘটনা। কিছু কিছু হামলার খবর আমরা জানি; কিন্তু বেশির ভাগ হামলার খবরই জানা যায় না।
তুর তার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলার সিদ্ধান্তের কারণে মূল্য দিয়েছেন। মুহূর্তেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো, তিনি খ্যাতি পাওয়ার জন্য হামলার নাটক সাজিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী ফুয়াদ চৌধুরী দাবি করেছেন, সাংবাদিকরা বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য আক্রমণের নাটক সাজায়। এ ধরনের মন্তব্যে তুরের পাশে দাঁড়ানো সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। আমার কাছে মনে হলো, এটা আমাকেই বলা হলো। এটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমার ওপর হামলার কথা। আমাকে ছয় ছয়টি গুলি করার পর আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হয়েছিল, এগুলো সব সাজানো।
বক্তৃতায় বলেছিলাম, যদি সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ বন্ধ না হয়, তাহলে আমরা চুপ থাকব না। কোনো ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার নাম নিইনি। তবে আমার কণ্ঠভঙ্গি বেশ কঠিন ছিল। আমার বিরুদ্ধে দ্রুত পাকিস্তানের শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার অভিযোগ আনা হয়। একটি সতর্ক সমন্বিত প্রচারণা সোস্যাল মিডিয়ায় আমাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং খুব দ্রুত সারা দেশে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় বয়ে যায়। আমার টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, টকশো উপস্থাপনা করতে পারব না। তারা আদালতের কোনো আদেশ কিংবা কারণ দর্শানোর কোনো নোটিশ প্রদান ব্যতিরেকেই আমার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস ‘সমালোচনার কণ্ঠরোধ’ করতে মিডিয়ার মালিকপক্ষদের চাপের নিন্দা জানিয়েছে। পাকিস্তানের সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো আদালতে আমার পক্ষে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা আমার অবস্থানের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে। কেননা, আমি তাদের প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কথা বলেছিলাম। স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, আমি আমার বক্তৃতায় কারো নাম উল্লেখ করিনি এবং একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীকে সম্মান করি। তবে আমি সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণে চুপ থাকতে পারি না। এমনকি যদি আমার শক্ত কণ্ঠভঙ্গিতে কেউ আঘাত পেয়ে থাকে, সেটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলেছিলাম। তবে আমি এ দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছি যে, সাংবাদিকদের ওপর হামলার অবসান ঘটাতে হবে। ২০০৭ সালে একনায়ক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ যখন জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, তখন আমাকে কয়েক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছিলেন। ২০১২ সালে মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর টিটিপির হামলার সমালোচনা করার পর আমার গাড়িতে পেতে রাখা বোমা উদ্ধার করা হয়। ২০১৪ সালে মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থা থেকে ফিরে আসার পর থেকে এখনো আমার দেহে দু’টি গুলি বহন করছি। এরপর আমি নবী অবমাননার অভিযোগেরও মুখোমুখি হয়েছি। তবে আদালতের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।

আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আরোপের চেষ্টা পাকিস্তানে ভিন্নমত প্রকাশের বিরুদ্ধে সুসংহত যুদ্ধের একটি অংশ। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ সবার বিরুদ্ধেই এই আইন ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই আইনের অস্পষ্টতা বিস্তৃত ধারাগুলোর অপব্যবহারে সুযোগ করে দেয়। কেবল ফেসবুকের কোনো পোস্টকে লাইক দেয়া, কার্টুন আঁকার জন্য কিংবা বক্তৃতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হতে পারে। বর্তমানে বিরোধী দলের দু’জন পার্লামেন্ট সদস্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মুখোমুখি। একজন মিয়া জাভেদ লতিফ। স¤প্রতি তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। অপরজন আলি উজির। তিনি গত ছয় মাস ধরে একটি বন্দী সেলে রয়েছেন।

রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের দণ্ডবিধি ১২৪-এর এ ধারা ’১৯ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকের দমন আইনের অনুরূপ। ওই আইন ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেফতারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এর কারণ তিনি বিখ্যাত বক্তব্য দিয়েছিলেন, ‘এটি নাগরিকদের স্বাধীনতাকে দমন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা, সাংবিধানিক আইনজীবী মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন এবং জিতেছিলেন। হাস্যকরভাবে সেই সরকারগুলো যারা নিজেদের দেশপ্রেম নিয়ে গর্ব অনুভব করে, এখনো ব্রিটিশ ঐতিহ্য লালন করে যাচ্ছে। ভারতে মোদি সরকার শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ব্যবহার করেছেন। আর পাকিস্তানে গত বছর ইমরান খানের সরকার পার্লামেন্টে আইন থেকে আমাদের মুক্তির প্রয়াসকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করে দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের প্রস্তাব করেছে। ওই সংস্থাটি নোটিশ বা শুনানি ছাড়াই কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না, কী লেখা যাবে, কী লেখা যাবে না সে সিদ্ধান্ত নিতে মিডিয়া ট্রাইব্যুনাল চালু করবে। অপরাধীদের তিন বছরের কারাদণ্ড ও লাখ লাখ রুপি অর্থদণ্ড হবে। এই আইন মিডিয়াকে সম্পূর্ণ নীরব হতে বাধ্য করবে। সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা সবাই একই কণ্ঠে এই খসড়া আইনের নিন্দা করেছেন। ঐক্যের এই নতুন দৃশ্য আশার আলো দেখাচ্ছে। যদি আমরা সবাই বজ্রকণ্ঠে এবং নির্ভয়ে কথা বলি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের কথা শোনা হবে। এভাবে আমাদের বাপ-দাদারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং এভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব, যারা আজ আমাদের নীরব করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ”

এইগুলি কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটা সংবাদ প্রকাশের জন্যে বা একটা মতামত প্রকাশের জন্যে আপনারা যে কেউ যে কোনদিন একই রকম পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। কেননা ঐ মৌলিক নীতিটা- যে, কারো কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না, কথা বলার স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার, এই নীতিটা আমাদের দেশে এখন বাস্তবে অনুপস্থিত। আইনের বইতে হয়তো লেখা আছে কোথাও, কিন্তু বাস্তবে শুধু কথা বলার জন্যেই যে কাউকে যে কোন সময় এইরকম জেলে পুরে দেওয়া যায়, মেরে ফেলে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *