পাকিস্তানে ব্লাসফেমির চার্জে আট বছরের শিশু

পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করাকে ‘ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার ‘ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই অপরাধের মৃত্যুদন্ড সহ কঠোর শাস্তি দেয়া হয়।যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআরএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১০০ জনের বেশি এই ‘ব্লাসফেমির অপরাধে’ কারাগারে আটক রয়েছেন৷ তাদের অর্ধেকই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি৷

কোনো ধর্মীয় সমাবেশে গন্ডগোল করা, অন্য ধর্মের সমাধিস্থানে প্রবেশ করা, ধর্মীয় বিশ্বাস অপমান করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধর্মীয় স্থান বা বস্তু ধ্বংস বা তার ক্ষতি করাকে বোঝায় ।এই আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করার জন্য কখনো কখনো শুধু অভিযোগই যথেষ্ট হয়।

গত মাসে পাকিস্তানে আট বছরের এক হিন্দু শিশু ইচ্ছাকৃতভাবে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কার্পেটে মূত্রত্যাগ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে ।

তাই এই শিশুটিকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুলিশের কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। দেশটির ইতিহাসে এটি ধর্ম অবমাননায় সবচেয়ে কমবয়সীর বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা। সোমবার এক প্রতিবেদনে এ কথা জানা গেছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।

খবরে বলা হয়েছে, শিশুটিকে, এক সপ্তাহ ধরে কারাগারে রাখার পর, জামিনে মুক্তি দেয়ার হয় যা পাকিস্তানের জনমানসে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং তারা স্থানীয় একটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুরের করেন ।

পরিবার ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই তারা নিজ বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন । গত সপ্তাহে একদল মুসলিম পর ছেলেটি জামিনে মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় মন্দির ভাঙচুর করা হয়। উত্তেজনা নিরসন ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
ছেলেটির পরিবারের মতে, শিশু মনমধ্যে ধর্ম অবমাননার বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেই । তার বয়সটি বিবেচনা আনা উচিত । মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। সে এখনও জানেই না কোনটা ভুল আর সঠিক ।

এই ঘটনা প্রথম না, এর আগে ইসলামের নবী মোহাম্মদকে অবমাননার অভিযোগে আসিয়া বিবিকে ২০১০ সালে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়। প্রতিবেশিদের সঙ্গে ঝগড়ার সময় তিনি নবীর অবমাননা করেন বলে অভিযোগ করা হয়। তার মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার মুসলিম প্রতিবেশী এবং একটি কাজের লোক । পরে আন্তর্জাতিক চাপে, তাকে বিদেশে বিদায় করে পাকিস্তান ।

৩৩ বছর বয়সী জুনাইদ হাফিজকে ২০১৩ সালের মার্চে গ্রেফতার করা হয়। নবী মুহাম্মদকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অসম্মানসূচক মন্তব্য করার অভিযোগ আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় ।

২০১৯ এ দেশটির দক্ষিণ প্রদেশের সিন্ধু প্রদেশে মহানবীকে (সা.) নিয়ে একজন হিন্দু অধ্যক্ষ অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন বলে একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ তুললে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷

জন (ছদ্ম নাম) খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন সুপরিচিত নাম যিনি পাকিস্তানেই ব্যাংকিং পেশায় কর্মরত ছিলেন এবং রাজনীতিও করতেন। এই ব্যক্তির জীবনই পাল্টে যায় যখন তার মাত্র তের বছর বয়সী সন্তানকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করায় ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি স্ত্রী ও দু সন্তানসহ যুক্তরাজ্যে শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন কিন্তু ওই অভিযোগ এখনো তার পিছু ছাড়ছেনা।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনকে কেন্দ্র করে মামলা, হত্যা, সাজার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে৷ দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরও এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে৷ ২০২০ তে হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তান (এইচআরসিপি) জানিয়েছে গত এক মাসে ৪০টিরও বেশি এমন মামলা নিবন্ধন করেছে পুলিশ৷ ‘

আগের বছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজনকে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভিতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ হত্যাকারীকে ‘ধর্ম যোদ্ধা’ অ্যাখ্যা দিয়ে তার মুক্তির দাবিতে তখন মিছিলও করে কয়েক হাজার কট্টর সমর্থক৷

বিচার চলাকালীন এমন হত্যার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ১৯৮০-র দশক থেকে এখন পর্যন্ত ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে এমন ৭৫ জন ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷

পাকিস্তানে অনেকবারই খ্রিস্টান , শিখ, হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে বিতর্কিত ব্লাসফেমি আইন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে প্রতিশোধস্পৃহা মেটাতে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে এই আইন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।অ্যামনেস্টি’র মতে, “অভিযুক্তরা তাদের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে যখন চেষ্টা করতে থাকে, তখন ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত জনতা পুলিশ, স্বাক্ষী, আইনজীবি এবং বিচারকদের পর্যন্ত হুমকির মুখে রাখে।”

পাকিস্তান ছাড়া ইরান, সৌদি আরব এবং মৌরিতানিয়া ব্লাসফেমি’র অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি দিয়েছে। তবে মোট কতগুলো মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে সেবিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই।
বাংলাদেশে এই আইন নেই , তবে বিবিসি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ”ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মত কোন কথা যদি লেখায় থাকে, অবশ্যই আমাদের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক। আমি একজন মুসলমান। এখন নবী করিম সা: সম্পর্কে কেউ যদি আজেবাজে কথা লেখে, আমরাতো চুপ করে বসে থাকতে পারি না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।কেউ হয়তো ধর্ম না মানতে পারে, তার মানে এই না যে তারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলবে বা নোংরা কথা লিখবে।”
ইউরোপের বেশকিছু দেশেও ব্লাসফেমি আইনে মামলা হওয়ার নজির রয়েছে।

ডেনমার্ক – কোরান পুরানোর একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করায় ২০১৭ সালে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে অভিযোগ আনা হয়।

ফিনল্যান্ড – ইসলাম বিষয়ে একটি ব্লগ পোস্টে অবমাননাকর মন্তব্য করায় ২০০৯ সালে এক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়।

জার্মানি – ‘কোরান,পবিত্র কোরান’ লেখা টয়লেট পেপার বিলি করায় ২০০৬ সালে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

জার্মানি – গাড়িতে খ্রিস্টান বিরোধী স্টিকার লাগানোর দায়ে ২০১৬ সালে এক ব্যক্তিকে ৫০০ ইউরো জরিমানা করা হয়।

আয়ারল্যান্ড – টিভি অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ কমেডিয়ান স্টিফেন ফ্রাই’য়ের মন্তব্যের কারণে অভিযোগ আনা হলে তদন্ত চলে তাঁর বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে একটি গণভোটে ব্লাসফেমি’কে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয় জনগণ।

আইসল্যান্ড, নরওয়ে আর মাল্টাও সাম্প্রতিক সময়ে ব্লাসফেমি আইন বাতিল করেছে।

তথ্য সহায়তা:
১. পাকিস্তান সংক্রান্ত তথ্যগুলো ইন্টারনেটে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋন করা ।
২.https://www.bbc.com/bengali/news-46095518

৩. https://www.theguardian.com/…/eight-year-old-becomes…

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *